বাংলাদেশের ই-কমার্স সেক্টরের উন্নয়ন, আসন্ন বাজেট এবং ই-ক্যাব
Published : জুন ২৩, ২০১৭ | 2336 Views

বাংলাদেশের ই–কমার্স সেক্টরের উন্নয়ন, আসন্ন বাজেট এবং ই–ক্যাব
আমাদের দেশের ই–কমার্স খাতের সমস্যা নিয়ে নতুন করে বলবার কিছুই নেই। প্রধান সমস্যা গুলো হচ্ছে–
• দেশের মানুষের বড় অংশ অনলাইনে কেনাকাটা সম্পর্কে সচেতন নয়।
• আস্থার অভাব আরেকটি বড় সমস্যা। এজন্যেই দেশের অনলাইন ক্রেতারা ক্যাশ–অন–ডেলিভারি মোডে ক্রয় করতে পছন্দ করেন। দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কাছে কার্ড থাকলেও অনলাইনে কেনাকাটায় তারা তা ব্যবহার করেন না।
• সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ডেলিভারি এবং উন্নত অবকাঠামো। বাংলাদেশের সব জায়গায় এখনো পণ্য ডেলিভারি করা সম্ভব নয়। এছাড়াও দেশে উন্নত ওয়্যার হাউজ/ফুলফিলমেন্ট সেন্টার তৈরি হয় নি যেগুলো অনলাইন অর্ডার দ্রুত প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে।
এখন এসব সমস্যার সমাধান কিভাবে করা যায়? বাংলাদেশের বেশির ভাগ ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র বা মাঝারী প্রতিষ্ঠানের ক্যাটেগরিতে পড়ে। এছাড়াও বড় বড় যেসব অনলাইন মার্কেটপ্লেস আছে যেমন– দারাজ, কেইমু, বিক্রয় ডট কম এর মতো প্রতিষ্ঠান গুলোর অত মূলধন নেই যে তারা অ্যামাজন বা আলিবাবার মতো বিশাল বিশাল ফুলফিলমেন্ট সেন্টার বা ওয়্যারহাউজ নির্মাণ করবে বা ডেলিভারির জন্যে নিজস্ব পরিবহন ব্যবহার করবে।
তাহলে উপায় কি? একটা উপায় হচ্ছে যেভাবে চলছে সেভাবে চলতে দেয়া। আরেকটা উপায় হচ্ছে সরকারের সাথে মিলে দেশের যেসব অবকাঠামো আছে ই–কমার্সের বিস্তারে সেগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যেমন– পোস্ট অফিস, বাংলাদেশ রেলওয়ে, ইত্যাদি।
এছাড়াও বর্তমান সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের চারটি মূল ফোকাস সেগুলো হচ্ছে– human resource development, people involvement, civil services and use of information technology in business। “use of information technology in business” মানেই ই–কমার্স। তাই বলা যায় যে, বর্তমান সরকার ই–কমার্সের গুরুত্ব সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল।
বর্তমানে সরকার সপ্তম পঞ্চ–বার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১৬–২০২০) বাস্তবায়ন করছে। সপ্তম পরিকল্পনায় সরকার যেসব আইসিটি কৌশল প্রণয়ন করেছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেবে সরকার–
• ই–কমার্স এবং ট্রেডের মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণ এবং লেনদেন খরচ কমানো
• সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি উন্নয়ন)
• আর্থিক লেনদেন সহজীকরণ
• প্রযুক্তি পার্ক নির্মাণ
• ইনোভেশন ইকোসিস্টেম এবং স্টার্ট–আপ ইনকিউবেশন সৃষ্টি করা
সূত্রঃ ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে অগ্রযাত্রাঃ হালচিত্র ২০১৬
আর কিছুদিন পরেই নতুন অর্থবছর শুরু হবে এবং নতুন বাজেট ঘোষিত হবে। ২০১৭–১৮ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। আমাদের বাসায় কালের কন্ঠ রাখা হয়। গত সপ্তাহের সোমবার (মে ৮, ২০১৭) পত্রিকাটি ২০১৭–১৮ বাজেট নিয়ে একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। এই ক্রোড়পত্রটি পড়ে বেশ অবাক হলাম। ২০১৭–১৮ বাজেট হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট। বাজেটের পরিমাণ সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা।
আজকে আবার নিউজ রিপোর্টে প্রকাশিত হয় যে নতুন অর্থ বছরে সরকার এক লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করেছে এবং এতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে পরিবহন ও জ্বালানি খাত।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে– সরকার এত বড় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে, এত বিশাল আকারের এডিপি নিচ্ছে, কিন্তু ই–কমার্স সেক্টরের উন্নয়নে কিছুই করছে না? ই–কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সমস্যা গুলোর সমাধানে এত বড় বাজেটে বরাদ্দ রাখতে পারবে না?
এই প্রশ্নের পিঠে আমার উত্তর হচ্ছে– সরকার মানুষের মনের কথা জানে না। ই–কমার্স ব্যবসায়ীদের সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়ে তাদের সমস্যা, সম্ভাবনা, অভাব, অভিযোগ ইত্যাদি তুলে ধরতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে এবং আলোচনা করতে হবে। আপ্নারা এগুলো যত বেশি করবেন তত বেশি সরকার বুঝবে যে আপ্নারা আপনাদের ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপারে সিরিয়াস। তখন সরকারও আপনাদের কথা সিরিয়াসলি নেবে।
এবং ঠিক এই কাজটি করার জন্যেই ই–কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই–ক্যাব) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ই–ক্যাব সরকারের কাছে দেশের ই–কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সমস্যা ও সম্ভাবনাকে তুলে ধরবে। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল, ই–ক্যাব বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকারের সাথে আলোচনা করেছে এবং ই–কমার্স ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নে অনেক কিছুই করেছে। এ বছরের শুরুতে ই–ক্যাব সফলভাবে দেশের প্রথম ই–কমার্স উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছে। গত বছরের শেষে ডাক–বিভাগ ই–কমার্স সেবা চালু করেছে এবং ই–ক্যাব প্রথম থেকেই এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছে এবং ই–ক্যাব নেতৃবৃন্দ নিয়মিত ডাক–বিভাগের সাথে আলোচনা করেছেন। এছাড়াও গত বছরের অক্টোবর মাসে ই–ক্যাব দেশের ই–কমার্স পলিসি কনফারেন্স করে বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের সাথে আলোচনা করে। ই–কমার্স নীতি প্রনয়ন হলে তাতে কি কি থাকবে তা নিয়ে এখানে দিনভর বিস্তারিত আলোচনা হয়। আশা করছি খুব দ্রুত ই–কমার্স পলিসির কাজ সম্পন্ন হবে।
সরকার কিন্তু একজন বা দুইজন ব্যবসায়ীর কথার উপরে ভিত্তি করে তার নীতি, বাজেট এগুলো নির্ধারণ করেন না। সরকার পুরো একটি ইন্ডাস্ট্রি তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সেই ইন্ডাস্ট্রির গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত গুলো নেয়। ই–ক্যাব বাংলাদেশের ই–কমার্স ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধি। সোজা কথায় দেশের ই–কমার্স ব্যবসায়ী, ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারী, তাদের সবার প্রতিনিধিত্ব করছে ই–ক্যাব। ই–ক্যাব যদি শক্তিশালী হয় তাহলে তার সুফল দেশের ই–কমার্স ইন্ডাস্ট্রি উপভোগ করবে। ই–ক্যাবের সমৃদ্ধি মানেই দেশের ই–কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সমৃদ্ধি। আর ই–ক্যাবকে শক্তিশালী করতে হলে ই–ক্যাবের সব সদস্যদের মধ্যে একতা থাকতে হবে। তাদের একসাথে কাজ করতে হবে।
কিন্তু ই–ক্যাব এর মধ্যেই যখন অন্তর্কোন্দল হবে এবং ই–ক্যাবের বিরুদ্ধে কোন কাজে ই–ক্যাবের লোকরাই সমর্থন দেবে তখন কিন্তু ই–ক্যাব শক্তিহীন হয়ে পড়বে। যখন ই–ক্যাব শক্তিহীন হয়ে পড়বে তখন কিন্তু আর সে ই–কমার্স ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে না। এতে করে ই–কমার্স ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্থ হবেন ভবিষ্যতে।
ই–ক্যাব নেতৃবৃন্দ বাজেট নিয়ে আলোচনা করেছে সংশ্লিষ্ট সরকারি মহলের সাথে এবং প্রস্তাবনাও পেশ করেছে। কিন্তু আমার মনে হয়, ই–ক্যাব সদস্যরা যদি এ ধরনের কাজগুলো না করতো এবং একসাথে থাকত তাহলে এই বাজেট থেকেই ই–কমার্স ইন্ডাস্ট্রির জন্যে বিশাল বরাদ্দ পাওয়া যেত। কিন্তু এই অন্তর্কোন্দলের কারণে ই–ক্যাব আশানুরূপ ভূমিকা পালন করতে পারে নি।
Published : জুন ২৩, ২০১৭ | 2336 Views